• Latest News

    পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য


    সন্তান-মায়ের নাড়িকাটা ধন। রক্তের বাঁধন, অতি আপনজন। এই পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে বড় আপনজন আর কেউ নেই। মা-সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। দশমাস দশদিন পেটে রাখেন। গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় সন্তান মায়ের দেহ থেকে নাভি দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করে। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার সময় প্রসবকালীন কি যন্ত্রণা মাকে সহ্য করতে হয় তা ভূক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবেনা। জন্মের পর সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হয়। তখন মায়ের দুধই হয় শিশুদের প্রধান খাদ্য। পবিত্র কুরআনে দুই বছর পর্যন্ত শিশুদের দুগ্ধদানের জন্য আল্লাহ সকল মাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব মানুষ জন্মের পর বড়ই অসহায় থাকে। এক অসহায়ত্বের মেয়াদ হবে বেশ কয়েক বছর। এহেন অসহায় অবস্থায় প্রধান সাহায্যকারী থাকে মা। মা-অতি আদর যত্নে শিশুকে লালন-পালন করেন। সব সময় তার পরিচর্যা করেন। অসুখ-বিসুখে বিনিদ্র রজনী যাপন করে সেবা শুশ্রুষা করেন। কণকণে শীতের রাতে পর্ণকুটিরে কুপি জালিয়ে অসুস্থ শিশুকে পাহাড়া দেন। মমতার চাদর দিয়ে রৌদ্রের প্রখর উত্তাপ থেকে রক্ষা করেন।
    মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার পর প্রতিটি শিশু ‘মা-মা’ বলে কান্না করে। এই কান্নার বিশেষ মমার্থ রয়েছে। দৈবভাবেই প্রতিটি শিশু হয়ত জানে না, এই পৃথিবীতে মা-ই তার প্রথম ও শেষ আশ্রয়স্থল। শিশুর মুখে যখন বোল ফোটে তখন সে প্রথমে মাকেই ডাকে। মা যেই ভাষায় কথা বলেন, সন্তানও সেই ভাষায় কথা বলতে শিখে। তাইতো প্রতিটি জাতি তাঁদের মুখের ভাষাকে মাতৃভাষা বলে অভিহিত করেন। আর মাতৃভাষা প্রতিটি দেশের জাতীয় সম্পদ। মাতৃভাষার মাধ্যমেই একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্বকীয় স্বত্ত্বা গড়ে ওঠে। জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত গর্বিত যে, এদেশের সন্তানেরা তাঁদের মায়ের ভাষা রক্ষা এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে এক সোনালী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন যা বিশ্ব পরিমন্ডলে বিরল। ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের এই আত্মত্যাগ জাতি যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আর বাংলাদেশী মায়েরা তাঁদের শহীদ সন্তানদের জন্য বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে সবসময় দাঁড়াতে পারবেন।
    মা-সন্তান জন্মদান করলেও পিতার ঔরসেই সেই সন্তান তাঁর গর্ভে আসে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া সৃষ্টির আদি থেকেই এই প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। ব্যতিক্রমটি হলো হযরত ঈসা (আঃ)-এর কোন পিতা নেই। আল্লাহ্র হুকুমে বিবি মরিয়ম এর গর্ভে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম ধর্ম হতে মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)। তাঁর স্ত্রী-মা হাওয়া (আঃ)। আদম-হাওয়ার মিলনের ফসল হলো আজকের এই মানব বাগান। হযরত ঈসা (আঃ) কে পিতা বিহীন সৃষ্টি করে আল্লাহ্ পাক হয়ত মানব জাতিকে তাঁর সৃষ্টি বৈচিত্র বা রহস্য দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীগণ হযরত ঈসা (আঃ) কে যিশু নামে অভিহিত করে তাঁকে ঈশ্বরের সন্তান বলে মনে করে থাকেন- যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। সৃষ্টি রহস্য যাই হোক না কেন সন্তান লালন-পালন ও পরিবারের ভরণপোষণে পিতার ভূমিকা অপরিসীম। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পিতা পরিবারের ভরণপোষণ বহন করেন। সন্তানদের অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করেন। যেই সন্তানের পিতা নেই তাকে এতিম বলা হয়। পিতার গুরুত্ব যে কত বেশী তা এতিম সন্তানগণ মর্মে মর্মে অনুভব করে। পরিবারকে একটি ঘর হিসেবে কল্পনা করলে পিতা হলেন সেই ঘরের মূল কাঠামো। জীবন ধারণের সকল উপকরণের যোগানদাতা।
    পিতা-মাতা যৌথভাবে সন্তানকে লালন পালন ও মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সন্তান বড় হবার পর ওদের দেখভাল করার দায়িত্ব তার উপর বর্তায়। বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা জীবন নির্বাহের জন্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাঁদের সাথে সদাচরণ করা, আজীবন ভরণপোষণ দেয়া, রোগ-শোকে সেবা করা প্রত্যেক সন্তানের একান্ত কর্তব্য। সন্তানের সদাচরণ পাওয়া পিতা-মাতার অধিকার। এই ব্যাপারে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ধর্মে পিতা-মাতাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের অবস্থান অতি কঠোর। পবিত্র কুরআন-এ আল্লাহ্পাক বলেছেন- ‘‘আমি মানুষকে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করে, তাকে স্তন্যপান ছাড়তে দু’বছর সময় লাগে। তাই আমার ও পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’’                                                                                            (সূরা লোকমান- ১৪)
    এই সূরায় আল্লাহ্পাক তাঁর পরই পিতা-মাতার স্থান নির্ধারণ করেছেন। সন্তান যাতে পিতা-মাতার অবাধ্য না হয় এবং সবসময় তাঁদের সম্মান করে সেজন্য পবিত্র কুরআনে বার বার তাগাদা দেয়া হয়েছে। এই ব্যাপারে আল্লাহ্পাক পুনরায় বলেছেন, ‘‘তোমার রব, তিনি ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করতে এবং পিতা-মাতার প্রতি সদব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছেন। তাদের একজন বা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলেও তাদেরকে বিরক্তিসূচক কিছু বলোনা, তাদের ভৎর্সনা করোনা এবং তাদের সাথে সম্মান সূচক নম্র কথা বলবে।’’
    (সূরা বনী ইসরাঈল- ২৩)।
    হিন্দু ধর্মেও পিতা-মাতাকে সম্মান করা এবং তাঁদের ভরণপোষণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মহামান্য মনুর মতে ‘‘শত অপরাধে অপরাধী হলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতা, সতী স্ত্রী এবং শিশুর ভরণপোষণকে কখনো অগ্রাহ্য করা উচিত নহে।’’
    হিন্দু আইন মতে, ‘‘একজন হিন্দু কোন সম্পত্তির মালিক হোক বা না হোক তার স্ত্রী, নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা এবং বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণ দিতে আইনগতভাবে বাধ্য।’’
    পিতা-মাতাকে সম্মান করা এবং তাঁদের ভরণপোষণ দেয়া ইবাদতের অংশ। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘‘হালাল উপার্জন দিয়ে পরিবারের জন্য যেই ব্যয় নির্বাহ কর হয় তা আল্লাহ্র নিকট সদকা হিসেবে বিবেচিত হয়।’’
    তাছাড়া সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া আল্লাহ্ সর্বাগ্রে কবুল করেন। পবিত্র হাদিস মতে তিন শ্রেণীর মানুষের দোয়া আল্লাহ্ সরাসরি কবুল করে থাকেন। তাঁরা হলেন মজলুম, মুসাফির এবং পিতা-মাতা। যে সন্তান পিতা-মাতার সেবা করে তার ইহকাল ও পরকালীন জীবন ধন্য হয়। এটা অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, আমাদের দেশের সন্তানেরা তাদের পিতা মাতাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। সমাজে হাজার হাজার যুবক আছে যারা পিতা-মাতা সংসারের ভরণপোষণের জন্য বছরের পর বছর বিদেশে পরবাসে থাকে। পিতা-মাতা এবং ভাইবোনদের ভরণপোষণের জন্য তাদের অনেকে সঠিক সময়ে বিয়ে পর্যন্ত করতে পারেনা।
    মোটর চালক এক যুবকের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম, তার পিতা-মৃত্যুর সময় স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান রেখে গেছেন। পিতৃপরিবারের ঐ সকল সদস্যদের ভরণপোষণের দায়িত্ব এখন বড় সন্তান হিসেবে তার উপর বর্তিয়েছে। বিয়ে করেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে সে বলল, ‘‘স্যার- আমার পরিবারে মা ও ভাই বোনসহ ছয়জন সদস্য রয়েছে। তাদের ভরণপোষণের জন্য আমাকে রাতদিন পরিশ্রম করতে হয়। উপার্জিত টাকা দিয়ে সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিয়ের কথা ভাবতে পারছিনা।’’
    তার এ কথাগুলিকে আমাদের গ্রামীণ সমাজের হাজার হাজার যুবকের কথার প্রতিধ্বনি বলেই মনে হলো। আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধন এতই দৃঢ় যে, পরিবারের যে কোন সদস্য অন্যান্যদের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেনা। এদেরকে সুসন্তান বলা হয়। আর সুসন্তানগণ হলো পিতা-মাতা ও দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
    আমরা জানি মানুষ মরণশীল। এই পৃথিবীতে কেউ চিরদিন বেঁচে থাকতে পারেনা। মৃত্যুর পর মানুষের আমলনামা বন্ধ হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তিনটি কাজের সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের কবরে পৌঁছে। কাজ তিনটি হলো মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকাকালে যে সকল সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করেছেন ঐ গুলি যতদিন পর্যন্ত চালু থাকবে ততদিন তার কবর ঐ সকল কাজের সওয়াব পৌঁছে যাবে। দ্বিতীয়ত মৃত ব্যক্তি যদি কাউকে ইলম শিক্ষা দিয়ে থাকেন ঐ শিক্ষা যতদিন জারী থাকবে ততদিন তিনি সওয়াব পাবেন। তৃতীয়ত মৃত ব্যক্তি যদি নেক সন্তান রেখে যান তার জন্য ঐ সন্তানের দোয়া আল্লাহ্ কবুল করবেন। মৃত পিতা-মাতার জন্য দোয়া কিভাবে করতে হবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন। তা হলো-
    ‘‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’’
    (সূরা বনি ইসরাঈল- ২৪)
    কাজেই পিতা-মাতার উচিত সুসন্তান রেখে যাওয়া এবং সন্তানদের কর্তব্য হল পিতা-মাতার সেবা করা। এতেই সকলের মঙ্গল নিহিত রয়েছে।র্
    • Blogger Comments
    • Facebook Comments
    Item Reviewed: পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য Rating: 5 Reviewed By: Sakir
    Scroll to Top